ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী
আজকের আলোচনা থেকে আপনারা ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী সেইসঙ্গে ইঁদুরের দ্বারা যে ক্ষতিগুলো হতে পারে, ইঁদুর কর্তৃক ক্ষয়ক্ষতির ধারণা এবং ইঁদুর দমন করার কিছু পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিচের লেখাগুলো মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকেন।
স্তন্যপায়ী জীবের প্রজাতী আজ বিশ্বে প্রায় ৪১০০টি। এদের মধ্যে ইঁদুর অন্যতম। বর্তমানে ইঁদুরের ক্ষতিকারক প্রজাতী আছে ২০টি।
পেজ সূচিপত্রঃ ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী
ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী
ইঁদুরের দ্বারা যে ক্ষতিগুলো হতে পারে
ইঁদুর কর্তৃক ক্ষয়ক্ষতির ধারণা
ইঁদুর দমন করার কিছু পদ্ধতিসমূহ
পরিশেষে
ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলীঃ
ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে ইদুরের বৈজ্ঞানিক নাম। অর্থাৎ induijje magirfua। বিজ্ঞানীদের দাবি, ইঁদুর নাকি মানুষের মতো কল্পনা করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইঁদুর অন্য সময়ের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার কথা তারা মনে করতে পারছে এবং সেইসঙ্গে তারা ভাবনা-চিন্তাও করতে পারছে।
যে পরিস্থিতি বা বাস্তবে তারা ওই মুহূর্তে নেই, সে কথাও ইঁদুরেরা ভাবতে পারছে। শুধু তাই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে— ভার্চুয়াল বাস্তবে ভাবনা-চিন্তা করে ইঁদুরেরা কোনো বস্তুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলতেও সক্ষম।
আরও পড়ুন: রক্ত দেওয়া-নেওয়ার আগে যে বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন
ইঁদুরের তথ্যাবলী সম্পর্কে গবেষণার জন্য ভার্জেনিয়ার হাওয়ার্ড হিউস মেডিকেল ইনস্টিটিউটের জেনেলিয়া রিসার্চ ক্যাম্পাসের একদল গবেষক এই পরীক্ষায় নেমেছিলেন। গবেষকরা ভার্চুয়াল বাস্তবতায় মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ মাপতে এক বিশেষ ধরনের যন্ত্র (ব্রেন মেশিন ইন্টারফেস) তৈরি করেছিলেন। এরপর গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপরে সেটি প্রয়োগ করা হয়।
গবেষণায় তারা দেখেছেন, নতুন পরিবেশ ও ঘটনায় মানুষের মতো ইঁদুরের মস্তিষ্কেও উদ্দীপনা তৈরি হয়। ইঁদুরের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশ (যেখানে আমাদের স্থান, কালসংক্রান্ত স্মৃতি ও তথ্য জমা থাকে) সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তারা পূর্ব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও তথ্য থেকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তবে ইঁদুরের তথ্যাবলী সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ গবেষণায় তারা সাদা ইঁদুর বা অ্যালবিনো ইঁদুরেরই ব্যবহার করেন। গবেষকগণ বলছেন, ইঁদুরের জিনের সঙ্গে মানুষের জিনের বেশ মিল থাকায় গবেষণার প্রাথমিক ধাপে সাদা অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। বায়োলজিক্যাল ও বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের যে কোনো গবেষণা কাজের প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষার জন্য সুইচ অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুর ব্যবহার করা হয়।
ইঁদুরের দ্বারা যে ক্ষতিগুলো হতে পারেঃ
ইঁদুর এমন একটি ক্ষতিকারক প্রাণী যার দ্বারা লোহা, পাথর বাদে প্রায় সকল বস্তুরই ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। এর ক্ষতির মুখ থেকে কাপড়-চোপড়. বইপত্র, দলিল, দস্তাবেজ, কাগজপত্র, ঘরবাড়ী বা আসবাবপত্র, নদীর বাঁধ, সেচনালা, ক্ষেতের ফসল ইত্যাদি কোনটিই রেহাই পাইনা। এছাড়াও ইঁদুর কর্তৃক নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, যেমন-প্লেগ, সালমোনেলা, লেপ্টোস্পাইরোসিস (ইত্যাদি অসুখগুলো লিভার ও কিডনির ক্ষতি করে), হান্টাভাইরাস (ইঁদুরের কামড়, জ্বর ও কলেরা) ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো ইঁদুর তার রোগ ছড়ায় কামড় দিয়ে, আঁচড় দিয়ে, প্রস্রাবের মাধ্যমে, মল ত্যাগ বা দূষিথ খাবার ও পানির মাধ্যমে। সর্বোপরি, আমাদের দৈনন্দিন সংসারে ব্যবহৃত এমন কোন জিনিসপত্র নাই যেটি ইঁদুরের ক্ষতির শিকার হতে পারেনা। অনেকেই ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি কারণে বাড়িতে বিড়াল পোষে। মোটকথা সংসার জীবনে ইঁদুর ক্ষতি করতে পারেনা এমন কোন জিনিসই নেই এবং তার সাথে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপরও মারাত্মক হুমকি এবং ঝুঁকি করে তুলতে পারে ইঁদুর।
ইঁদুর কর্তৃক ক্ষয়ক্ষতির ধারণাঃ
ইঁদুর মাঠে ফসলের প্রায় ১২% পর্য্যন্ত এবং ঘরে গুদামে শস্যের প্রায় ৫% নষ্ট করতে পারে। ইঁদুর কর্তৃক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। যেমন-বাংলাদেশে ইঁদুর বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য শষ্য নষ্ট করতে পারে, যার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকার মত। তবে এই হিসাব প্রায় আশির দশকের প্রথম দিকের, বর্তমানে এর হেরফের হতেও পারে। তবে ২০২৪ সালের মে মাসে The Daily Star পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান-২০২৩ এর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটি তথ্য প্রদান করে। অর্থাৎ সে তথ্যানুযায়ী বলা হয়, “২০২২ সালে ১,৬৪,৫৮,৯২৯টি ইঁদুর মারা হয়। যার ফলে প্রায় ১,২৩,৪৪২ মেট্রিক টন ফসল রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে, যার তৎকালীন বাজারমূল্য প্রায় ৪৯৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।” এ ছাড়াও প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, ২০২১ সালে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১৮টি ইঁদুর নিধন করে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার মেট্রিকটন ফসল বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
আরও পড়ুন: কিভাবে পটাশিয়াম রক্তচাপকে প্রভাবিত করে
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে করা এক গবেষণার তথ্য অনুসারে তারা বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল। অর্থাৎ তাঁরা ইঁদুর সম্পর্কিত তথ্যে বলেছেন এখানকার ফসলের মাঠ ছাড়াও এই অববাহিকায় অবস্থিত হাট-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে ইঁদুরের আক্রমনে বছরে উৎপাদিত আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গমের ৪ থেকে ১২ ভাগ, গোল আলুর ৫ থেকে ৭ ভাগ ও আনারসের ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট করে। সবমিলিয়ে ইঁদুর গড়ে মাঠ ফসলের ৫ থেকে ৭ শতাংশ ও গুদামজাত শস্যের ৩ থেকে ৫ শতাংশের ক্ষতি করে। নষ্ট করে ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচনালা।
ইঁদুর দমন করার কিছু পদ্ধতিসমূহঃ
খুবই কঠিন কাজ হলো ইঁদুর দমন করা, তাই কৌশল অবলম্বন করতে হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ইঁদুরের দৃষ্টিশক্তি বেশ দুর্বল, তবে শ্রবণ শক্তি ও স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর। মূলত এই সমস্ত কারণে ইঁদুর মারতে বা দমন করতেও অনেকগুলি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে-
- ফাঁদ পেতে মারাই বেশ উত্তম। কারণ এতে করে কোন প্রকার রাসায়নিক ঔষুধের প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশ বান্ধব।
- তবে ফাঁদ পেতে না মারতে পারলে এদের আশ্রয়স্থল এবং মজুদ খাদ্য ও বাসস্থান নষ্ট করে দিতে হবে, এ ছাড়াও এদের যদি তাড়া করা যায় তাহলে তারা ঐ এলাকায় অন্ততঃ ৩ সপ্তাহ আসবেনা।
- বিশ টোপ দিয়ে মারা বেশ কষ্টকর। বিষ দিয়ে মারলে হলে প্রথম দু’দিন বিষ ছাড়া একই খাবার দিতে হবে। কারণ প্রথম দু’দিন তারা পরিবেশিত খাদ্যগুলি একটু খেয়ে পরীক্ষা করবে যে তাদের শরীরে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না? যদি শরীরে কোন প্রতিক্রিয়া না হয়. তবেই তৃতীয় দিন তারা ঐ খাবার পেট ভরে খাবে এবং বাচ্চাদেরও খাওয়াবে। আর যদি প্রথম দু’দিন খাবার খেয়ে শরীরে কোন প্রতিক্রিয়া হয়, তবে ঐ খাবার আর খাবেনা এবং ঐ খাবারের আশে-পাশে প্রস্রাব করে দিবে, এতে করে অন্য ইঁদুররা ঐ প্রস্রাবের গন্ধ পেলে তারা আর খাবারের আশ-পাশে যাবে না। অন্য কোন ইঁদুর আর ঐ খাবার খাবেনা।
- মাঠে ইঁদুর দমনের জন্য যদি পেঁচা বসার সুবিধা করে দিতে পারেন, তাহলে পেঁচা কিন্তু ইঁদুর ধরে এদের বংশ নিয়ন্ত্রণ করবে।
- বাসায় বা গুদামে বিড়াল পুষলে বিড়াল এদের বংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। জেনে রাখা ভালো যে, বিড়াল ইঁদুর ধরতে/খেতে পছন্দ করে। তবে বাসায় বিড়াল পুষলে বিড়ালের গায়ের গন্ধে এবং কণ্ঠস্বরের কারণে ইঁদুর আর বাইরে বের হয়না।
- রাতে এদের চলাফেরার পথে যদি মোটা রশি কিম্বা কলা পাতার বোঁঠা সাপের মত করে ফেলে রাখলে সাপ মনে করে ইঁদুর ঐ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী-পরিশেষেঃ
জেনে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশে ১২টি প্রজাতীর ইঁদুরের মধ্যে খুব বেশি ক্ষতিকারক ৫টি এবং কম ক্ষতিকারক ৭টি প্রজাতী রয়েছে। ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি এবং শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। ইঁদুর কিন্তু কয়েকদিন ধরে সাঁতার কাটতে পারে পারে এবং স্বপ্নও দেখে থাকে। মজার ব্যাপার ইঁদুর কিন্তু হাসে তবে তা উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি শব্দ করে, আর সবথেকে বড় বিষয় হলো ইঁদুর একা থাকতে পছন্দ করে না। যাইহোক আজকের ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন: একজন মানুষ সর্বোচ্চ কতটুকু রক্ত দিতে পারবে
অনেকেই এই ইঁদুর তাড়ানোর জন্য সাদা ইঁদুর যেটাকে অনেকে বিলাতি ইঁদুর বলে থাকে, তা বাসায় পোষে। অর্থাৎ এই সাদা ইঁদুরগুলো কিন্তু বাড়িতে থাকা মেটা বা কালো বা ধরা ইঁদুরগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। সুতরাং ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী যদি কোন মন্তব্য/পরামর্শ থাকে তাহলে তা অবশ্যই কমেন্টের মধ্যে জানাতে পারেন। পরিশেষে আজকের ইঁদুরের বিচিত্র জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলী বিষয়ক আলোচনায় আপনার দীর্ঘক্ষণ উপস্থিতি ও সম্পৃক্ততার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
=========================================================================
বি:দ্রঃ- সাবধান! ইঁদুর মারার জন্য বিষ ব্যবহার করলে কিন্তু গৃহপালিত প্রাণীও মারা যেতে পারে, এমনকি ছোট বাচ্চা ও মানুষেরও ক্ষতি হতে পারে। তাই ইঁদুর মারার বিষ ব্যবহার করার আগে আপনার এবং আপনার পরিবারের সকলেই সতর্ক ও সচেতনত থাকতে হবে।

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url